সন্তান সান্নিধ্যে সুস্থতার আশায় জীবন্মৃতকে চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছেন ডাক্তার

Image

ছয় মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি এক জীবন্মৃত মহিলা, তাঁর পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে বাড়ি পাঠানো হল তাঁকে। একি হসপিস কেয়ার, নাকি হাসপাতালের বেড খালি করার প্রয়াস?
লিখছেন পিয়ালী দে বিশ্বাস।
সঙ্গে হসপিস সম্বন্ধে সম্পাদকীয় সংযোজন করা হয়েছে।

রাইলস টিউবের সাহায্যে খাওয়া, বেঁচে থাকতে হলে একটি মানুষের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত যে যে কাজ করতে হয়, সে সব কাজই অন্য কাউকে দিয়েই সারতে হয় তাঁকে। কারও কথারই উত্তর দেন না, চিনতে পারেন না স্বামীসহ অন্যান্য আত্মীয়দের। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মাঝে মাঝে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া প্রায় সবই ভুলে গেছেন তিনি। ভুলেছেন স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নেওয়াটাও। গলায় শ্বাসনালিতে ফুটো করে ট্রেকিওস্টোমি নল পরিয়ে রাখা হয়েছে, যার সাহায্যে নিশ্বাস নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন বছর তিরিশের গৃহবধূ গীতিকা দাশ, প্রায় ৬ মাস ধরে ভর্তি ছিলেন এসএসকেএম-এর আইটিইউ-তে। তাঁর ছ-মাসের বাচ্চাকে এখনও দেখেননি গীতিকা দেবি। বাড়িতে ১৩ বছর ও ৬ বছর বয়সের আরও দুই মেয়ে আছে। হয়তো ওই সন্তানদের চোখ তুলে দেখবেনও না কোনোদিন। কিন্তু মা আর সন্তানের রসায়ন নাকি জগতের সব নিয়মের থেকে আলাদা। সেই রসায়নকে কাজে লাগিয়েই মিরাক্যালের অপেক্ষায় আছেন ডাক্তাররা। বাড়ি গেলে দ্রুত সুস্থ হতে পারেন, এই আশা নিয়েই রাইলস টিউব আর অক্সিজেনের নল দিয়ে তাঁরা পুজোর আগে চতুর্থীর দিন বাড়ি পাঠিয়েছেন গীতিকাকে। তাঁদের আশা, সন্তানদের ভালোবাসার স্পর্শে যদি নতুন করে বেঁচে ওঠেন গীতিকা।

এসএসকেএম হাসপাতালের আইটিইউ-র প্রধান রজত চৌধুরি জানিয়েছেন, ‘একজন মানুষ সবচেয়ে ভালো থাকেন তাঁর বাড়ির পরিচিত পরিবেশেই। চেনা মুখ, চেনা পরিবেশ এই ধরনের রোগীদের সুস্থ হতে সাহায্য করে তা প্রমাণিত সত্য। আমরা আশা করছি, নিজের সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের স্পর্শ ও ভালোবাসায় গীতিকা আরও সুস্থ হয়ে উঠবে। বিদেশে রোগীকে বাড়ির পরিবেশ দিতে হাসপাতালের মধ্যেই রোগীর প্রিয়জনদের থাকার ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশেও বেসরকারি ক্ষেত্রে কয়েকটি জায়গায় “হসপিস”-এর ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে এখনও এই ধরনের পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে ৬ মাস গীতিকাকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা চালানোর পরামর্শ দিয়েছি, তারপরে কোনো সমস্যা হলে আমরা তো আছিই। ফোনের মাধ্যমে সবসময় পরিবারের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে আমাদের।’

  • ভারতের প্রথম হসপিস—শান্তি অবেদনা সদন মুম্বাইয়ে ১৯৮৬-তে, পরের ৫ বছরের তার দুটি শাখা দিল্লী ও গোয়ায়।
  • গৌহাটি পেন এন্ড প্যালিয়াটিভ কেয়ার সোসাইটি আসামে।
  • জীবোদয়া হসপিস চেন্নাইয়ে।
  • ক্যানসাপোর্ট দিল্লীতে।
  • লক্ষ্মী প্যালিয়েটিভ কেয়ার ট্রাস্ট চেন্নাইয়ে।
  • করুণাশ্রয় হসপিস চেন্নাইয়ে।

কথা রেখেছেন ঐ চিকিৎসক, প্রয়োজনে ফোন করলেই তাঁর পরামর্শ পেয়েছেন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও গীতিকার পিঠে প্রায় দেড় ইঞ্চি গভীর বেডসোর হয়েছে। তা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য প্রতিদিন ড্রেসিং করাতে হচ্ছে। ড্রেসিং-এর জন্য প্রতিদিন ৫০০ টাকা খরচ করার মতো আর্থিক অবস্থা নেই গীতিকার পরিবারের। স্বামী মিন্টু দাশ-এর কথায়, ‘শুধু ওই খরচই নয়, প্রতিদিনের ওষুধ পথ্য ও আনুষঙ্গিক কোনো খরচ চালানোর মতো পরিস্থিতি নেই আমাদের পরিবারের।’ মিন্টুবাবু ট্রলারে করে মাছ ধরতে যান। মাসিক আয় ৬ থেকে ৭ হাজারের মতো। ‘যা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালানো গেলেও আমাদের দেশে চিকিৎসা চালানো সম্ভব নয়। অবস্থা এমন যে এখন গীতিকার চিকিৎসার জন্য পাড়া থেকে চাঁদা তুলতে হচ্ছে। জানিনা সে সাহায্যও আর ক-দিন পাব?’

গত এপ্রিলে সিজারিয়ান সেক্সান প্রসবের ১ ঘণ্টার মধ্যে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে হাই- পোক্সিক ইস্কিমিক এনকেফালোপ্যাথিতে আক্রান্ত হন তিনি। খিঁচুনি হতে থাকে তাঁর। এসএসকেএম-এ চিকিৎসকরা তাঁকে দেখেই আইটিইউ-তে ভর্তি করে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করেন। আইটিইউ-এর চিকিৎসক ও নার্সদের নিরলস চেষ্টাতেই ওই পরিস্থিতি থেকে কিছুটা সুস্থ হয়েছেন গীতিকা। এখন নিজে নিজে না খেতে পারলেও প্রেসার স্বাভাবিক রয়েছে এবং ভেন্টিলেশনও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকেরা তাঁর বাড়ির লোকেদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কীভাবে রাইলস টিউবে খাবার খাওয়াতে হয় বা সাকশান মেশিনের সাহায্যে শ্লেষ্মা বের করতে হয়। ডা. রজত চৌধুরি জানিয়েছেন, যেহেতু গীতিকা দেবীর মস্তিষ্কের টিস্যু স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই কারণে তিনি স্বাভাবিকভাবে নাক দিয়ে নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছেন। এমন অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছেন তিনি। ফলে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কীভাবে তাঁকে শুশ্রূষা করবেন, সে বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন তাঁর পরিবারও। এসএসকেএম-এ থাকার সময়েই রোগীর চিকিৎসা চালাতে দিনপিছু হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছিল, প্রতিদিনের সেই খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল গীতিকা দেবীর পরিবারের কাছে। তার উপর আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা একটি পরিবারের পক্ষে রাইলস টিউব, সাকশান মেশিন, নেবুলাইজার, সাকশান ক্যাথিটার, বিশেষ সুবিধাযুক্ত বিছানাসহ অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থার আয়োজন করা সত্যিই সমস্যার ছিল। পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে গীতিকাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখার পরিকাঠামো তৈরি করতে সবমিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকার সামগ্রী কিনতে হয়েছে তাঁদের। তাঁর স্বামী মিন্টু দাশ-এর আক্ষেপ, ‘জমি কেনার জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। স্ত্রী-র চিকিৎসার পেছনে সেই টাকা সব শেষ। বহু কষ্ট করে এই ১৫ হাজার জোগাড় করেছি। ডাক্তারবাবুরা বাড়ি নিয়ে যেতে বলার জন্যই আমরা ওঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছি। কিন্তু বাড়িতে বিদ্যুৎ সবসময় থাকে না। সাকশান মেশিনসহ অন্যান্য মেশিন চালানো আমাদের পক্ষে সমস্যার। কিন্তু ওঁকে বাঁচাতে তো হবে।’ গীতিকার পরিবারের এক আত্মীয়ার দাবি বাড়ি আনার পর মেয়েদের ডাকে চোখ মেলে তাকায় গীতিকা। অন্য কোনো অভিব্যক্তি না প্রকাশ করলেও চোখের সাহায্যে কিছু বলতে চায়।

কিন্তু এইভাবে মুমূর্ষু রোগীকে পরিবারের সান্নিধ্যে পাঠানোর জন্য হাসপাতালের আইটিইউ থেকে বের করা কতটা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তান বা বাড়ির লোকেদের সংস্পর্শে এই ধরনের রোগীর কতটা উন্নতি হবে তা জানা নেই, এসএসকেএম হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাকেন্দ্রে নতুন রোগীদের বেডের সুযোগ দেওয়ার জন্যই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সম্পাদকীয় সংযোজনঃ যে ধরনের যত্নের চেষ্টা করা হচ্ছে গীতিকা দেবীর জন্য, তা বিদেশে বহুল প্রচলিত, তাকে বলা হয় হসপিস যত্ন (hospice care)।

হসপিস কোন নির্দিষ্ট স্থান নয়, হসপিস যত্নের এক দর্শন, যত্নের এক পরিকাঠামো। এই যত্ন দেওয়া যেতে পারে রোগীর বাড়িতে, হাসপাতালে, নার্সিং হোমে বা জীবনের অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে।

হসপিস আসলে বলা হত ক্লান্ত পথযাত্রীদের জন্য নির্মিত আশ্রয়স্থলকে। একাদশ শতাব্দীতে, ১০৬৫ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ক্রুসেডাররা সেরে উঠবেন না এমন রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রথম যত্নের ব্যবস্থা করেন। তারপর চতুর্দশ শতাব্দীতে রোডসে, সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের যত্নের সূচনা হয়। ১৯০২-’০৫ সময়কালে অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, জাপান, চীন ও রাশিয়ায় হসপিস যত্ন বিস্তার লাভ করে। আধুনিক হসপিস যত্নের ধারণার জন্ম দেন সিসিলি সন্ডার্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ষাটের দশকে।

হসপিস সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো এই রকমঃ--*কেবল ক্যানসার রোগীদের বা মরণাপন্ন মানুষদের জন্য *যখন পরিবারের লোকেরা যত্ন নিতে সক্ষম, তখনই কেবল কাজে লাগে *যাঁদের উঁচু স্তরের যত্নের প্রয়োজন নেই, তাঁদের জন্যই কেবল হসপিস *যাঁরা মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত কেবল তাঁদের জন্যই এই পরিষেবা *এতে খরচ বেশি *যখন কোনো আশা নেই তখনই কেবল হসপিস।

কিন্তু বাস্তব হলঃ--*৮০% হসপিস পরিষেবা বাড়িতে দেওয়া হয় *দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর অন্তিম স্তরের রোগীদের এখন বেশি বেশি করে হসপিস যত্ন দেওয়া হচ্ছে *সব বয়সের মানুষকেই হসপিস পরিষেবা দেওয়া যায় *হসপিস দুঃখকাতর রোগীর পরিবারকেও মরণাপন্ন রোগীর মতোই গুরুত্ব দেয় *অনেক সময়ই বিকল্প স্থান বা বিকল্প পরিষেবা সম্ভবপর হলেও হসপিস যত্ন দেওয়া যায় *হসপিস বেদনা কমানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে *হসপিস মানুষকে নিজস্ব গতিতে নিজের রাস্তা খুঁজে বার করতে সাহায্য করে *অনেক সময়ই হসপিস জীবনের অন্তিম সময়ের অন্যান্য চিকিৎসার চেয়ে কম খরচের।

হসপিস যত্নের স্তর বিভাগ এই রকম—১। ঘরে রেখে রুটিন যত্ন, ২। ঘরে রেখে লাগাতার যত্ন, ৩। হাসপাতালে ভর্তি রেখে সাধারণ যত্ন, ৪। রেস্পাইট যত্ন অর্থাৎ কম সময়ের জন্য রোগীর পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে অন্য ব্যবস্থা করা।

হসপিসের টীমে থাকেন— ১। প্রাথমিক চিকিৎসক, ২। হসপিস চিকিৎসক, ৩। নার্স, ৪। গৃহ স্বাস্থ্য সহায়ক, ৫। ধর্মগুরু, ৬। স্বেচ্ছাসেবী।

হসপিস রোগীর যত্ন নেয়, ব্যথা ও রোগের অন্যান্য উপসর্গগুলোর চিকিৎসা করে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রয়োজন মেটায়, কাউন্সেলিং করে, অপূর্ণ আইনী বা আর্থিক বিলিবন্দোবস্ত করতে এবং মৃত্যুর পর দাহ/ কবরের ব্যবস্থা করায় রোগীকে সাহায্য করে, ধর্মীয় প্রয়োজন মেটায়।

রোগীর পরিবারের সদস্যদের হসপিস কাউন্সেলিং করে, রেস্পাইট কেয়ার দেয়, স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়, বাস্তবিক সাহায্য করে, দাহ বা কবর দেওয়ায় সাহায্য করে, মৃত্যুর পর দুঃখ ভোলাতে সাহায্য করে।

আমাদের দেশে সমস্ত মানুষের জন্য হসপিসের মতো পরিষেবা কবে পাওয়া যাবে?!

লেখকঃ পিয়ালী দে বিশ্বাস এক বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক।