আমার লেখাপত্র

এক পৃথিবী লিখতে চেয়েও একটি মাত্রও পাতা লেখা হল না। আমার লেখাপত্রের অবস্থা ঠিক এরকম।

কত কি নিয়ে লেখার ইচ্ছে! কাজের চাপে, সময়ের অভাবে তা আর খাতা বন্দি হয়ে ওঠে না। ভেসে থাকে মনে।

পাল্টে যাওয়া সমাজ, বদলে যাওয়া রাজনীতি, চিনতে শেখা মানুষ। দিন বদলের স্বপ্ন! আর একের পর এক যুদ্ধের বাস্তবতা। মাথার মধ্যে অনেক আঁকি-বুকি। কিন্তু তারা লেখা হয়ে ওঠে না আমার অবহেলায়। তবুও চেষ্টা করি কলম ধরতে। কারন সেটাও যুদ্ধাস্ত্র কি না!! সেসব বাধা কাটিয়ে, লেখাপত্রের এই অংশে আবার শুরু করছি না বলতে পারা সময়ের কথাগুলোকে নতুনকরে আমার লেখা দিয়ে বলতে।

নারীর জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার:
অতীত, আজকের বাস্তবতা ও নারীর মুক্তি সংগ্রাম

সমাজের দর্পণ যদি সাহিত্য হয় তবে, সিনেমা হল ফটোগ্রাফি। সম্প্রতি, বক্স অফিসে হিট "এ্যনিম্যাল" সিনেমার একটি দৃশ্যে আধুনিক শিক্ষিতা একটি মেয়েকে 'গুড বার্থ" উপযোগিতার টনিক খাওয়ায় নায়ক। সে বলে - সুন্দরী সেই নায়িকার শারীরিক গঠন উপযুক্ত সন্তান জন্ম দিতে কতটা সমর্থ! উত্তরে ব্রেইন বর্জিত নায়িকার চোখেও প্রশ্নাতীত ভালোবাসার ফানুস ওড়ে। একবিংশ শতকের উত্তর আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে মনুবাদী চিন্তাধারায় নিপীড়িত মেয়েটিকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ধারণার বাইরে কোন মন্তব্য করতে শুনি না!

প্রিয় পুরুষটির মগজ ধোলাই এর বাইরে বেরিয়ে সে একবারও একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন তোলেনা! "কেন, আমার শরীর কি শুধুই সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য? আমার জ্ঞান, মেধা, বিশ্বাস জুড়ে এই রক্তমাংসের আমি কি শুধুই মেয়ে! একজন মানুষ নই?মানবাধিকার এবং মুক্তচিন্তার বিপরীত পথে হেঁটে যাওয়া অন্ধকার সময়ের এক চিলতে দলিল এই দৃশ্য। আজকের ভারতে তাই, নারীর জন্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নটাকে আরোও বেশি তাৎপর্যপূর্ণভাবে চোখে দেখার আছে। বিশেষকরে, ২০২৪-এ ১২৫ তম ৮ মার্চে পৌঁছেও নারী স্বাধীনতা বা লিঙ্গসাম্যের বিষয়টা এখনো যে শতযোজন দূরে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত তথা সমগ্র বিশ্বজুড়ে মেয়েদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে পদে পদে বঞ্চিত করার ঘটনার মাধ্যমে।

নারী বংশবৃদ্ধি করবে, পুরুষের মনোরঞ্জন করবে, এবং গোষ্ঠী বা কোনো ব্যক্তির প্রয়োজনে সে নিজে কোনো এক পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হবে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া পিতৃতান্ত্রিকতার এই ধার ও ভার আজও বহন করে চলতে হয় নারীকে। কারণ টা সহজ। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এত বছর পরেও দেশ কাল নির্বিশেষে এখনো যে কোনো সমাজে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘুর নাম নারী।

এদেশে ফ্যাসিজম দাঁত নখ বের করে ডালপালা মেলছে। এমন সময়ে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতে নারীমুক্তির আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাঁড় করাতে আমাদের অবস্থান ও ভবিষ্যৎ আদর্শকে স্পষ্ট করে নেওয়ার জন্যই এই লেখা। মনে রাখতে হবে ফ্যাসিজিম কখনোই নারীর স্বাধীন সত্ত্বাকে স্বীকার করে না। বরং নারীর বিকাশের পরিপন্থী হাজার একটা টুল তার চলার পথে ছড়িয়ে রাখে। মায়ের যোনিকে রক্তাক্ত করে বংশবৃদ্ধির ঝান্ডা ওড়ানোতেই ফ্যাসিবাদীদের উল্লাস।

তাই, শুধু সমাজ বিকাশের অধিকার নয় এমন সময়ে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নারীর অধিকার বুঝে নেওয়াটাও খুবই জরুরি। কারণ অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারীর স্বাস্থ্য কখনো লড়াইয়ের জন্য গণ্য হয়নি। অথচ হওয়া উচিত ছিল ঢের আগেই।

সন্তান বা আগামী প্রজন্মের জন্ম দেন নারী। প্রাকৃতিকভাবেই, এ দায়িত্ব তাদের নিতে হয়। অথচ মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা ,পুষ্টির সুরক্ষা, বা সন্তানের সুরক্ষা কোনটাই রাষ্ট্র তাকে নিশ্চিত করে দেয় না। কারণ যে পিতৃতান্ত্রিক শোষণ ব্যবস্থার মধ্যে আমরা থাকছি সেখানে সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্বের ভারও এসে পড়ে নারীর ঘাড়েই। আসলে, আমরা একটা পুঁজিবাদী সমাজে বাস করি । এখানে অসম অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রটাকে বাঁচিয়ে রাখা হয় ব্যক্তি পুঁজির ভোগ ও তার ব্যক্তি উন্নয়নের সংকীর্ণ স্বার্থে। এমন অসম ব্যবস্থায় কখনোই নারীর বিকাশ সম্ভব নয়। তাইতো শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ কেন? নারী কবে কখন কার সন্তান জন্ম দেবে বা আদৌও জন্ম দেবে কি না এই সিদ্ধান্ত আজও নারীর হাতে নেই। এমনকি নিজের স্বাস্থ্যের অনুকূলে কোন সিদ্ধান্তই সে নিতেও পারে না। এ দেশে নারীরা উদয়াস্ত শ্রম দিয়ে সন্তান ও সংসারের সমস্ত কাজ বছরের পর বছর সামলেও, গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বা সামাজিক বিষয়ে আজোও মেয়েদেরকে তাদের মতামত দেওয়ার কোনো অধিকার দেওয়া হয়না। পরিবারে বা সমাজে আজোও বেশিরভাগ জায়গায় নারী স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। এটাই বাস্তব। আসলে পারিবারিক কাঠামোতে বংশবৃদ্ধিকে কাব্যিক শব্দ সাজিয়ে দেখতে পছন্দ করে সমাজ। তাইতো, মাতৃত্বের গরিমায় আলোকিত নারীর উপরেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের সমস্ত অন্ধকার বর্তায়।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে এদেশের যাবতীয় জন্ম নিয়ন্ত্রণের ভার বইছে মেয়েরাই। তথ্য অনুসারে বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনায় যেসব আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার হয় তার ৭৫ শতাংশই হল নারীদের বন্ধ্যাত্বকরণ অপারেশনের কাজ। এমনকি, সারা পৃথিবী জুড়ে যত লাইগেশন হয় তার ৩৬ শতাংশ হয় এ দেশেই। (Baker, 2023)।

কলুর বলদের মত এটাই কর্তব্য জেনে পিষতে থাকে মেয়েরা। নির্মম সত্য এটাই যে পুরুষদের কন্ডোম ও ভ্যাসিকটমি ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণের সমস্ত উপকরণ গুলি শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যই তৈরি হয়েছে। তুলনায় ব্যবহার সহজ এবং সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও এদেশে কনডম ব্যবহার করেন মাত্র ১২ শতাংশ পুরুষ। আর ভ্যাসিকটমি হয় আরো কম পুরুষের, মাত্র-৬ শতাংশের। স্ত্রী-পুরুষদের এই অসমতার অনুপাতটা সহজেই বোঝা যাবে, সংখ্যার হিসেবে ২০১৯- ২০২০ সালে ভারতে মেয়েদের বন্ধ্যাত্বকরণ অপারেশন হয় ৩৪ লক্ষ ২৪৫৮ জনের। সেখানে ভ্যাসিকটমি হয়েছে মাত্র ৫৫ হাজার ৩২৪ জন পুরুষের। সংসার যদি দুই চাকার গাড়ি হয় তবে কেন একটি চাকার ওপর এই ভার বর্ষণ?

নিন্দুকেরা বলবেন এ তো শুধুমাত্র দাম্পত্যের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, আর তার পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া কিছু যৌথ সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে এত কাটাছেঁড়া কেন? সত্যিই কি তাই! জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য নারী শরীরের ব্যবহার আগা গোড়াই চাপিয়ে দেওয়া হয়নি কি নারীদেরই ওপর? একটু পেছনে ফিরি। সরকারিভাবে ১৯৬০ থেকেই এদেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে মেয়েদের শরীরে লুপ বসাতে উৎসাহ দেওয়া হতো। ১৯৬৫ এর মার্চে হুগলির চুঁচুড়া চন্দননগর এবং শ্রীরামপুর এই তিন শহরাঞ্চলকে কেন্দ্র করে কলকাতার বাইরে লুপের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। সরকারি রেকর্ড অনুসারে ২৭শে নভেম্বর ১৯৬৫ পর্যন্ত বাংলার মোট ৯৮০৯৪ জন মহিলার শরীরে লুপ ব্যবহৃত হয়েছিল। ব্যবহারকারী মহিলাদের মধ্যে প্রথমে ছিল কলকাতা জেলা ও একদম শেষে কোচবিহার। সমসাময়িক সরকারি বিজ্ঞাপনেও কন্ডোম নয় বরং লুপ ব্যবহারের ওপরেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল বারবার। যদিও এর কয়েক বছর আগে আমাদের দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছিল জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ এড়াতেই। যেকোনো উন্নত দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অস্থায়ী ব্যবস্থাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতে প্রথম থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে স্থায়ী ব্যবস্থা অর্থাৎ বন্ধ্যাত্বকরণের দিকে হেঁটেছিল সরকার। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কমাতে শুরু হয়েছিল পুরুষদের ভ্যাসেকটমি ও মহিলাদের টিউবেকটমি বা লাইগেশন অপারেশন। প্রথমদিকে সরকারি তরফে অপেক্ষাকৃত সহজ অপারেশন ভ্যাসেক্টমির ওপরেই জোর দেওয়া হতো।কারণ টিউবেকটমি বা লাইগেশন এর তুলনায় ভ্যাসেক্টমি অনেক সহজ অপারেশন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই আউটডোরে পাঁচ মিনিট সময় ব্যয়ে ন্যূনতম খরচে অপারেশন করা যায়। চামড়ার নিচে লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে শুক্রনালী অর্থাৎ যে নালী দিয়ে শুক্রাশয় থেকে স্পার্ম পুরুষাঙ্গে পৌঁছায় সেটি কেটে, কাটা মুখ দুটি বেঁধে দিলেই অপারেশন কমপ্লিট। কিন্তু বাদ সাধলো জনতা। ১৯৬৫ সাল থেকেই ভারতে দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে "বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও ইউনাইটেড নেশনস ফান্ড ফর পপুলেশন অ্যাক্টিভিটি'র তরফ থেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে চাপ দেওয়া শুরু হয়েছিল। দেশব্যাপী লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হত রাজ্যগুলিকে। সরকারি তৎপরতায় ইনসেনটিভ-এর লোভ দেখিয়ে, কখনো বা জোর করে ব্যাপক হারে ভ্যাসিকটমি করা হতো দেশজুড়ে। এর প্রতিবাদেই মানুষ বিস্ফোরক হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের এই অসন্তোষ ভোটে প্রভাব ফেলে। জরুরী অবস্থার শেষে নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের কারণ হিসেবে জোর করে ভ্যাসেকটমি করানোকেই মূল কারণ হিসেবে বর্ণনা করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে, বন্ধ হয় ভ্যাসিকটমি। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ তো করতেই হবে! এমত অবস্থায়, পুরুষের সুখ সাধনার লক্ষ্যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে অপর পক্ষের বলিদান। এরপর থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ দায়টা ঠেলে দেওয়া হয় মেয়েদের ওপর। স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ অপারেশনের পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ, আই ইউ সি ডি কপারটি সহ সমস্ত জন্মনিয়ন্ত্রণের সব ধরনের টুল ব্যবহারের গিনিপিগ হয়ে ওঠে মেয়েরা। অপরদিকে সরকারি দায়িত্বপনায় পুরুষদের নির্বিজকরণ কর্মসূচি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

এই প্রথম নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজের স্বার্থে এর আগেও অসংখ্য বার নারীর অধিকার খর্ব করেছে, নারীর শরীরকে ব্যবহার করেছে বারে বারে। আমরা "ইউজেনিক স্টেরিলাইজেশন"-এর ইতিহাস জানি। যা ফ্যাসিজমের এক চূড়ান্ত কদর্য রূপ। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, জার্মানি, চীন-জাপানের মতো উন্নত দেশেও সমাজের 'বৃহত্তর' স্বার্থে নারী তথা সংখ্যালঘু জনের প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবহারের সাক্ষী থেকেছি। জোরকরে উইঘর মুসলিমদের জন্মনিয়ন্ত্রণ করার ঘটনা আজ প্রমাণিত। কয়েক শতক আগে আমেরিকা মেক্সিকো বর্ডারের অনুপ্রবেশকারীদের জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করার মত বিপদজনক ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হয়েছে। আমরা দেখেছি, জার্মানিতে হিটলারের জমানায়, ইহুদিদের জন্মের ওপর নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণের ঘটনা। যদিও (আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মানদন্ড এবং প্রভিধানগুলি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার) এস আর এইচ আর কিন্তু রাষ্ট্রের দ্বারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এই কদর্য পদ্ধতিকে কোনভাবেই স্বীকৃতি দেয় না। চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ডাব্লুএইচও, এসআরএইচআর, জাতিসংঘের মত একাধিক সংস্থা জোর করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির এইসব কদর্য পদ্ধতি গুলোকে দীর্ঘদিন ধরে বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছে। সেখানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে যে জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মহিলাদের অনুমতি নিতেই হবে। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়েই সত্যিটা অন্যরকম।

কোভিডের সময় থেকে কলকাতা ও শহরতলীর প্রান্তিক বস্তি গুলোয় জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার সূত্রে এটা আমার কাছে খুব পরিষ্কার যে জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই মহিলাদের কোনরকম অনুমতি নেওয়াই হয় না। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে সরকারি হাসপাতাল গুলিতে এই ঘটনা প্রায় ঘটে। প্রসবের পরে মা কে কিছু না জানিয়েই কপারটি পরিয়ে দেওয়া হয় সরকারি হাসপাতাল গুলিতে। স্বাস্থ্য কর্মীদের দিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে কখনো ইনসেনটিভ কখনো বেতন কাটা বা চাকরি হারানোর মতো ভয় দেখানোও হয়। এই কাজে তাদের চোখে রাষ্ট্রের কল্যাণকামী মূর্তির ঠুলি পড়ানো থাকে, যাতে এমনভাবে অনুমতি না নিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের এই কাণ্ডটিকে তারা যথার্থভাবে জাস্টিফাই করতে পারেন। এই ঘটনার স্বপক্ষে ২০২০ তে মধ্যপ্রদেশের একদল সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ১১ ই ফেব্রুয়ারির জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের একটি আদেশ নামার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। যেখানে বলা ছিল যে উক্ত রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের নির্দিষ্ট টার্গেট দেওয়া জন্ম নিয়ন্ত্রণের সংখ্যা পূরণ করতে পারেনি বলে তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে। বর্তমানে এ রাজ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ইনজেক্টটেবেল স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি শুরু করেছে সরকার। কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি ও শহরতলীর সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে মাসিক গর্ভ নিয়ন্ত্রক বড়ি, কনডমের সঙ্গেই রাখা হচ্ছে অন্তরা। কিন্তু কমিউনিটির মধ্যে আশা দিদিদের দিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি বা ইনজেকশনের বিষয়ে উৎসাহিত করা হলেও কনডম বিলির ব্যবস্থা প্রায় করাই হয় না। সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলিতে মূলত মহিলারাই পরিষেবা নিতে আসেন। ফ্যামিলি প্লানিং এর বিষয় গুলি নিয়ে এক্ষেত্রে মহিলাদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ থাকলেও পুরুষদেরকে সরাসরি পাওয়া যায় না, আর কখনো বা পুরুষদের পাওয়া গেলেও ভিন্ন লিঙ্গ বা স্টিগমার কারনেও মহিলা আশা কর্মীরা সে বিষয়ে উৎসাহ দেখাননা।

সবদিক থেকে দেখতে গেলে শুধু জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, কন্ডোম-সেক্স সবচেয়ে নিরাপদ ও সুরক্ষিত। এইচআইভি, সিফিলিস সহ নানান যৌন রোগের প্রতিরোধক হিসেবে এটি অব্যর্থ। এর পরেও দেশের মাত্র ১২ শতাংশ পুরুষ যৌনতার ক্ষেত্রে কন্ডোম ব্যবহার করেন, বাকিরা করেন না। জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে সহজ পন্থা কন্ডোম জেনেও, তারা ব্যবহার করেন না। যারা ব্যবহার করছেন না এরাই বা কারা? সরকারি তথ্য বলছে শিক্ষিত পুরুষদের মধ্যেও কন্ডোম ব্যবহারে অনীহা আছে। এরকমই একটা তথ্য পাই হাংরি জেনারেশনের পরিচিত কবি অরুণেশ চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি পড়ে (Quarini, 2005)। আমরা জানতে পারি, স্ত্রীর সঙ্গে তার নীরোদ ছাড়া সহবাসের কথা। অরুনেস যিনি বিবিসির নিয়মিত দর্শক, সারা পৃথিবীর খবর রাখেন, শিক্ষিত লেখক! আমার একজন প্রিয় লেখকও বটে।

এর কারণ বলতে গেলে কিছু সামাজিক স্টিগমা এবং সমাজে মেয়েদের অবস্থানকে চিহ্নিত করতেই হয়। মনে রাখতে হবে সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টি শারীরবৃত্তীয় হলেও, জন্মনিয়ন্ত্রণ বা সন্তান মানুষ করার মত বিষয়গুলি কিন্তু শারীরবৃত্তীয় নয়। তা সম্পূর্ণ সামাজিকভাবে চাপানো, যা বয়ে বেড়াতে কোন মেয়ে বাধ্য নয়। অথচ "আমার শরীর আমার স্বাধীনতা" এই দাবিটা দীর্ঘদিন নারী আন্দোলনের স্লোগান হয়েই থেকে গেল, বিশ্বাসে পরিণত হলো না। তাইতো বারবার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার চাপে টিউবেক্টমি বা লাইগেশন এর মত জন্মনিয়ন্ত্রণের স্হায়ী পথে পা বাড়াতে হয় মেয়েদের। যেখানে ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ৫ এর তথ্য অনুসারে আমাদের দেশে মেয়েদের গড় বয়স ২৬শেই বন্ধ্যাত্ব করণ অপারেশন হয়। (সুমিতা দাস, I RISE, ২০২৪)। অতএব মাত্র ২৬ বছর বয়সেই একজন মহিলাকে স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব করনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে রাষ্ট্র। কি করে পারছে? কারণ মেয়েরা আজো সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘু। যেকারনে তার জীবনের ঝুঁকি, নানান শারীরিক সমস্যার সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও তার ইচ্ছে গুরুত্ব পাচ্ছে না।

অপর দিকে কন্ডোম পরলে ছেলেদের সঠিকভাবে যৌনসুখ নিবৃত্তি হয় না, বা ভ্যাসিকটমির পরে পুরুষদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ার মত হাজার একটা মনগড়া ধারণাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হয় পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে সজীব রাখার জন্য। যাতে পুরুষের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা যেন আজীবন থাকে। এই যে নিজে শারীরিকভাবে কোন অক্ষমতার সম্মুখীন না হওয়া ,অথচ অপর লিঙ্গের উপর এমনই একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারা, এ তো দুর্বলের প্রতি সবলের আধিপত্য কায়েমের রূপ।সমাজ দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থাকে তেল জল জোগাচ্ছে। বিবাহে বা বিয়ের বাইরের কোন সম্পর্কে গর্ভপাত করানোর ক্ষেত্রেও নারীর একার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। এমনকি অবিবাহিত মেয়েদের সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান লাভের ইচ্ছে কেও প্রশ্ন তোলে এই রাষ্ট্র। এই বৈষম্য কি আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায় না? যেখানে নিজেদের প্রয়োজনে নির্লজ্জভাবে নারী শরীরের ব্যবহার করলেও একজন ব্যক্তি নারীর ইচ্ছের স্বাধীনতাকে আমরা স্বীকৃতি দিতে পারি না। এক সময় নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে সমকাজে সমবেতনের অধিকার আদায় করেছিল ইউরোপের শ্রমিক মেয়েরা। ‌শ্রমিক স্বাস্হ্য বজায় রাখতে আট ঘন্টার পরিসরে বেঁধে ফেলা গিয়েছিল কাজকে। আজকে হিন্দুত্বের সনাতন বিশুদ্ধতা বজায় রাখার ডাক দিচ্ছে ক্ষমতায় আসীন সরকার। আরএসএস-এর মত উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী কিছু সংস্থা মহিলাদের উপর বাধা নিষেধ আরোপ করছে। তারা পকসোর মতন আইন কেও শিথিল করে নারীকে রক্ষণশীলতার ফতোয়ায় মুড়তে চাইছে। যার প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে নারীদেরকেই। তাদেরকে বুঝতে হবে নিছক ৮-ই মার্চের পকেট ফ্রেন্ডলি ডিসকাউন্টে নয়, বরং "নারীর শরীর কোন যুদ্ধক্ষেত্র নয়" এই বার্তা তেই আছে মুক্তি।

মনে রাখতে হবে এর আগেও গান্ধী আমলের ৪০ বছর পরে রাষ্ট্রের অমানবিক ব্যবস্থার জেরে নারীদেরকে নিজের শরীরের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি (Chaudhuri, 2017) । জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণের রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপগুলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের তথা আগামী প্রজন্মের ক্ষতি করেছে। ও করেই চলেছে।

পরিশেষে বলতে চাই, আরোও একটা শ্রমজীবী নারী দিবস পার করে আমরা আমাদের লড়াইকে কোন বিন্দুতে দাঁড় করাতে চাইবো? যে বিন্দু থেকেই শুরু করা যেতে পারে আমাদের কাঙ্খিত সিন্ধু ছোঁয়ার বা 'অসম্ভব'-কে সম্ভব করার সংগ্রামী যাত্রা। আমাদের অনেকেরই জানা, ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের প্রথম ধাপে, সেই আদিম সমাজে প্রথম নারীর পায়ে বেরি পড়ানো হোলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকারের পিতৃতান্ত্রিক দায়ে - একজন সন্তানের পিতার পরিচয়কে নির্দিষ্টকরণের মধ্যে দিয়ে। সেই ধারাবাহিকতাতেই ব্যক্তি পুঁজির নিয়ন্ত্রণে নারীর শরীর আজোও যুদ্ধক্ষেত্র। তার ইচ্ছা চালিত হয় কর্পোরেট পিতৃতন্ত্রের ভোগ্যপণ্য বাজারের অশ্লীল কিছু নিয়মে। আমরা কখনো ট্র্যাডিশনাল, কখোনো বা আধুনিকতা কখনোবা উত্তরআধুনিকতার মতো কিছু তথাকথিত পবিত্রতার নানা মোড়কে তার দেখা পাই।তাই, এই ব্যবস্থার বাইরে বেরিয়ে নারীর জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্জন সহ একজন নারীকে যদি নির্দিষ্ট পিতৃতান্ত্রিক ছকে বাঁধা 'নারী পরিচিতি'র বাইরে একজন সুস্থ মানুষ হতে হয়, আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে হয়, তবে প্রত্যেক সমাজে নারীকে ঐ ব্যক্তি পুঁজি চলাচলের অশ্লীল নিয়মকে ধ্বংস করে দিতে হবে। নারীকে অস্বীকার করতে হবে পিতৃতন্ত্রের ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকারের দায়কে। এই দিশাতেই প্রকৃতভাবে নারীর মুক্তি ঘটবে, মুক্তি ঘটবে গোটা সমাজের । নইলে সহস্র বছর পরেও নারী মুক্তির প্রশ্নগুলো নিছক কিছু লিখে রাখা স্লোগান ও কিছু 'প্রগতিশীল' মানুষের বৌদ্ধিক চর্চার বিষয় হয়েই থেকে যাবে। বাস্তবে, নারীমুক্তির দাবিটা থেকে যাবে কবির কল্পনা রাজ্যের "অধরা মাধুরী"-তে বা "তুমি আমার আমি তোমার" হয়ে।

তথ্যসূত্র:
  • ১. সাবিত্রী ও জন্মনিয়ন্ত্রণে মেয়েদের দায়, সুমিতা দাস, RISE, পাতা, ৩৩ - ৩৯
  • ২. Quarini, C.A. (2005) ‘History of contraception’, Women’s Health Medicine, 2(5), pp. 28–30. doi:10.1383/wohm.2005.2.5.28.
  • ৩. Baker, C.N. (2023) A brief history of birth control, Our Bodies Ourselves Today. Available at: (Accessed: 07 March 2024).
  • ৪. Chaudhuri, Z.R. (2017) When Gandhi told British birth control activists that contraceptives were a sin, Scroll.in. Available at: (Accessed: 07 March 2024).

র‍্যাগিং ও পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব

পিয়ালী দে বিশ্বাস

আমি শিক্ষাক্ষেত্রে র‍্যাগিং বিরোধী। জীবনের ক্ষেত্রেও।

কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেদিন প্রথম মেয়েটি বুঝেছিল, ভাই বা দাদার তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, অনেক কিছু তার পেতে নেই, হারিয়ে যাওয়ার গন্ডি শুধু তার মনে মনেই। আসলে তাকে র‍্যাগিংই করা হয়েছিল।

গায়ের রং কালো বলে যেদিন মেয়েটির মা তার হাতে ফেয়ার এন্ড লাভলি তুলে দিয়েছিল। আসলে সেটাও র‍্যাগিংই হয়েছিল। সিগারেট মদ ছোয় না বলে অফিসের মেয়েটিকে যখন গেঁও বলে খিল্লি করা হয় আসলে সেটাও র‍্যাগিং।

রাইট টু এডুকেশনের ফাক গোলে দামি স্কুলে ভর্তি হওয়া ছেলেটির পাশ থেকে যখন সহপাঠীরা কুচকে যাওয়া জামায় নাকসিটকে সিট বদল করে আসলে সেটাও র‍্যাগিং।

অফিসের এককোনের ডেস্কের চুপচাপ ছেলেটিকে বিব্রত করতেই হয়। সময়ে অসময়ে বলির পাঁঠাও বানানো হয় তাকেই। এটাও র‍্যাগিংই। "মাই ড্যাডি স্ট্রঙ্গেস্ট"। টুকরো টুকরো এমন অনেক মুহূর্ত পার করি প্রতিদিন। অথচ মেরুদন্ড শক্ত হয় না। কই মুখো-বইতে প্রতিবাদে নামি না তো! মোমবাতি মিছিল! পাশ কাটিয়ে যাবার সময় একবারও কি মনে হয় দুর্বলের ওপর সবলের এই অত্যাচার বন্ধ হওয়া দরকার।

শুধু শিক্ষা কেন্দ্রে নয়, আসলে র‍্যাগিং আমাদের সমাজের সর্বত্র। শ্রেণী - জাত- লিঙ্গ- কর্ম ভেদে র‍্যাগ হতে হয় দুর্বলকে। ক্ষমতাবান মানুষের প্রিয় খেলা ক্ষমতাহীনকে সংকুচিত করা। আমি তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ- এ ভাবনায় জাড়িত হয় মানুষ। আসলে এমন মাৎসন্যায় আমাদের রক্তে। আমরা সেই রক্তধারা নিয়েই বড় হই, যাপন করি জীবন। ধারালো রক্তিম খর্গের পাশেই চোখ বন্ধ করে পেলব সবুজ গালিচা খুঁজি। কয়েকটা দিন চক্ষু মুদে ঘাড় গুঁজে থাকলে পরেই মুশকিল আসান। অন্ধ চৌকিদারের "আল ইজ ওয়েল" আমাদের নিশ্চিন্তি দেয়।

আর ক্ষমতাবানের হাতে এই ছোট হতে হতে খাদের কিনারে এসে দাঁড়ানো মানুষটির পা কখনো কখনো পিছলে যায়। তখনই স্বপ্নদীপের স্বপ্নভঙ্গ। শুধু শিক্ষাঙ্গনের আঙিনা নয় এমন রক্তে শাপিত হয়েছে অনেক উঠোন। কিন্তু আমরা সনাক্ত করি না, মৃত্যুকে দাগিয়ে দিই জীবনের নানান অজুহাতে। অথচ লড়াই করে বেঁচে থাকার এই খোলা প্রাঙ্গনে কেউ সিসি টিভির নজরদারি বসায় না।

ফেয়ার এন্ড লাভলী - White light and fair: পণ্য হয়ে যায় নারীর দেহ

পিয়ালী দে বিশ্বাস

নিক্তি মেপে ঠিক কতটা সাদা হলে সুন্দর হওয়া যায়?

খুবসুরতি বা সৌন্দর্য সবসময় ফর্সা হওয়ার সঙ্গে যুক্ত কেন?

আমাদের দেখা লৌকিক দেবদেবীদের গায়ের রং কিন্তু ঘন বা কালো। আদিম সেই রঙে কি কোন সুন্দরের ঘোর লাগেনা?

ছোটবেলা থেকে গল্প শুনে আসছি, কালি যখন খর্গ হস্ত, সেই রূপ দেখে মহাদেব স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তার সেই সংহারী মূর্তিতেই সে সবচেয়ে সুন্দর নয় কি? বা সবচেয়ে আবেদনময়ী?

বা একজন শিক্ষিকা যখন কোন দুর্বোধ্য বিষয় সহজ করে বুঝিয়ে দেন। সেই মুহূর্তেই কি তাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে না? তখন কি একবারও মনে আসে ! যে সে কালো নাকি ফর্সা ?

“আমার ভুবন” বাংলা চলচ্চিত্রে মেকআপ ছাড়া কালো চামড়ার নায়িকা নন্দিতা দাশ অথবা সাউথ ইন্ডিয়ান নায়িকার প্রতি কি কোনো পুরুষের আবেদনে ঘাটতি পড়ে ঐ নায়িকাদের কালো রঙের কারণে?

আচ্ছা যখন আমাদের মা, আমাদের আদর করেন, গরমে ঘেমে নেয়ে রান্নাঘর থেকে আলু থালু পোশাকে বেরোলেও আমাদের কাছে তিনি কি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নন?

তবে সৌন্দর্যে কেন এত ফর্সা কালোর ভেদাভেদ ? কেন চোখের সামনে এইসব উদাহরণ থাকতেও আমরা শুধু গায়ের রঙে সৌন্দর্যের খোঁজ করি? অদ্ভুত সব অযৌক্তিক সিনেমা, গান, বিজ্ঞাপন তৈরি হয় এই কালোদের ফর্সা হওয়ার গল্প নিয়ে? যেন ফর্সা হওয়াটাই জীবনের সফলতা। যেন ফর্সা হওয়া মানেই ম্যাজিক। সব সমস্যার মুশকিল আশান ! যেন ফর্সা মেয়েদের পনের দাবিতে পুড়তে হয় না ??

গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে দাপিয়ে বিক্রি হত ফেয়ার এন্ড লাভলীম নামের একটি ফেয়ারনেস ক্রীম। জনপ্রিয়তার নিরিখে দেশের এক নম্বর ফর্সা হওয়ার ক্রিম। Unilever কোম্পানির নিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর এ দেশে ৩০০ মিলিয়ন লোক এই ফর্সা হওয়ার ক্রিমটি কেনেন। ২০১৭ এর থেকে কোম্পানির লাভের পরিমাণ ছিলো ৮.৩ বিলিয়ন ডলার। কোভিডের পরে বাজারের মন্দা আরোও বেড়েছে, কমেছে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা। কিন্তু কসমেটিকস ও মেকআপে র বিক্রি বেড়েছে ১৩ শতাংশ। তথ্য বলছে সেই সঙ্গে বেড়েছে স্কিন হোয়াইটনিং এর ক্রেতা। কেন আধুনিক মানুষের এই দুস্থ মন??

সুদূর অতীতকাল থেকে চলে আসা সমাজের উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা নারীকে কেবলমাত্র একজন যৌনবস্তু হিসেবে দেখতে শেখায়। সেই সংকীর্ন পুরুষতান্ত্রিক বিচারেই কালো চামড়ার নারীরা আজো অব্দি নানা বৈষম্যের শিকারে আক্রান্ত। এ সমাজে নারীকে এমনিতেই ২য় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে দেখা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই কালো মেয়েদের অবমূল্যায়ন হয় ৩য় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে।

চিন্তা চেতনার দিক থেকে এগিয়ে থাকা সংখ্যালঘু কিছু পুরুষ ছাড়া একজন নারীকে সংখ্যাগরিষ্ট পুরুষ, এমনকি অনেক নারীও নিজেদেরকে ও অপর একজন নারীকে মানুষ না, কেবলমাত্র পুরুষের যৌনআকাঙ্খার মানদন্ডে দেখে থাকেন। এই অবস্থার বদল ঘটবে কবে?

ফর্সা হওয়ার ক্রিমে থাকা ষ্টেরয়েড ত্বকের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাকে কেড়ে নেয়। অনেকদিন টেরওয়েড ব্যবহারের পরে পাতলা হতে থাকে মুখের চামড়া। এমনকি স্টেরয়েডের জন্য অবাঞ্চিত রোম ও গজাতে পারে। এমনকি ফেয়ারনেস ক্রীম ব্যবহারে বহু স্কিন ক্যান্সারের ঘটনা সামনে উঠে এলেও দিনের পর দিন ব্যবহার আর বিক্রির পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বস্তির মেয়ে রাধা থেকে আম্বানি ঘরণী । সবাই এখন ফেয়ারনেস কালচারের প্রোডাক্ট। পিতৃতন্ত্রের উন্নততম ব্যবস্থা পুঁজিবাদের যুগে মেয়েরা নিজেরাই নিজেদেরকে পণ্য করে তোলে, করে তোলে রঙের পুতুল।