আমাদের কাজকর্ম

আমরা কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বস্তিগুলোতে আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা সাধারণ, দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি। আামাদের কাজের মূল জায়গা জুড়ে থাকে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, যে মা ও শিশুরা আমাদের সমাজে সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত।

কলকাতার জলে বিষ। সেই জল নিঃশব্দ ঘাতক হয়ে বইছে শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিশেষ একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে দূষণ ও খারাপ প্রয়-প্রণালীর জেরে শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ পানীয় জল আর সুরক্ষিত নেই। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জলে মিশে রয়েছে মাইক্রো ফাইবার, যা সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের অনু। মাইক্রো ফাইবারের অস্তিত্ব থাকলে তা থেকে ডায়রিয়া, আমাশা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস বি ও পোলিওর মত জল বাহিত রোগের সংক্রমণ হতে পারে। হতে পারে যে কোন ধরনের কৃমি সংক্রমণও। আমরা জানি এখনো প্রতি বছর ডায়রিয়া সংক্রমণে পাঁচ বছরের নিচে ৩৯ লক্ষের-ও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। অনিয়ন্ত্রিত পুঁজি, একতরফা অর্থনীতি, বেড়ে চলা নগরায়ন ও মানুষের লোভ আর এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য রাখছে না।

আগস্টের প্রথম থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত "বিশ্ব ব্রেস্ট ফিডিং সপ্তাহ"। শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ছ'মাস পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। মায়ের দুধ থেকেই শিশু সব রকমের পুষ্টি পায়। এই সময়, বাইরের কোন খাবার তার প্রয়োজন নেই। শিশুর পেট ভরছে না, এই ভেবে শিশুকে বাইরের খাবার দেওয়া হলে তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা সমস্যা হতে পারে। জন্মের পরেই মায়ের স্তন-বৃন্তে শিশুর মুখ ধরতে হবে, দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের ও বাচ্চার শরীরের সঠিক অবস্থানও খুব প্রয়োজনীয়। শিশুর নিচের দিকের থুতনি মায়ের স্তনের সঙ্গে লেগে থাকবে, আর ওপরের ঠোঁটটি উল্টানো অবস্থায় থাকবে। সঠিক পদ্ধতিতে শিশুকে ধরলে শিশু নিজের থেকেই দুধ টেনে খাওয়ার চেষ্টা করবে। বুকের দুধ খাওয়ার মাধ্যমে মা আর শিশুর মধ্যে দৃঢ় বন্ধন গড়ে উঠবে।

গর্ভাবস্থায় ন'টি বিপদ সংকেত থাকলে গর্ভবতীকে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ন্যাশনাল স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২০-তে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে আমাদের দেশে প্রতি লাখে ৯৭ -১০০ জন মহিলার মৃত্যু হয়। গর্ভাবস্থায় রক্তপাত, তলপেটে যন্ত্রণা, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা যন্ত্রণা, ঘনঘন জ্বর আসা, সময়ের আগে জল ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে প্রসূতির ও নবজাতকের জীবনের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। এই কারণেই গর্ভবতী মেয়ে বা মহিলাদের যত্ন নিয়ে কমিউনিটিতে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে মিটিং করা হয় আমাদের পক্ষ থেকে।

২০১৯-এর শেষের দিক থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হল এক অতিমারি, 'কোভিড-১৯'। হাঁচি, কাশি ও ড্রপলেট-এর মাধ্যমে খুব দ্রুত জীবাণু সংক্রমণ হয়ে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। অথচ তখন এর চিকিৎসা অজানা ছিল মানব সমাজে। নতুন এই জীবাণু সংক্রমণের ফলে ২০২০ মার্চের শেষ দিক থেকে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশের মতো আমাদের দেশেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে গৃহবন্দী হতে হোলো সাধারণ মানুষকে। জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা, পাতলা পায়খানা, পেটব্যথা, গা-হাত-পা যন্ত্রণা এবং নাকে গন্ধ না পাওয়া সহ বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দিলে কোভিদের জন্য সাসপেক্টেড হতো রোগী। কোন রোগী সংক্রমিত হয়েছে বুঝতে পারলে তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখা হতো। প্রথমদিকে ওটিই ছিল চিকিৎসা। সেই সঙ্গে উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হতো রোগীদের। অর্থাৎ জ্বরে প্যারাসিটামল। পাতলা পায়খানার জন্য জিঙ্ক ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রাথমিকভাবে গৃহবন্দী রাখার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে দূরত্ব অবলম্বন করা এবং মাস্ক্ পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল ঐ সময়। প্রথমে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের সঙ্গে শিশুদের কে মাস্ক্ পরে প্রতিরোধের কথা বলললেও পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে তিন বছরের নিচে শিশুর মাস্ক্ পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।

স্বাস্থ্যসূচকের নিরিখে এ রাজ্যের মধ্যে মহেশতলা মিউনিসিপালিটির বেশ কয়েকটি এলাকা পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের রুটিনাইজেশন ও অপুষ্টি জনিত বেশ কিছু রোগের সমস্যা রয়েছে এলাকায়। এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করে সেখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের চিকিৎসকদের দিয়ে বিশেষ ক্যাম্প করানো হচ্ছে।

সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি লাখে ৯৭ জন প্রসূতির মৃত্যু হয় এদেশে। তবুও মায়েদের প্রসবকালীন যত্ন নিয়ে সচেতন নই আমরা। আমাদের কাজের এলাকা কলকাতা পুরসভার ৮০ নাম্বার ওয়ার্ডের ইন্দিরাপল্লি বস্তি এলাকা। ব্রেসব্রিজ স্টেশনের পাশের এই জায়গার সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। প্রসবকালীন যত্ন তো দূরের কথা প্রসবের সময় হাসপাতালেও যেতে চান না ।

মানিকতলা খালপাড় এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ছবি আঁকার ক্লাস করাচ্ছি। ওই অল্প পরিসরে রাস্তার ওপর ধুলো ওড়ানো ক্লাসের সময়টা আমার জীবনে জমানো সম্পদ। বিশ্বাস করুন ওই বাচ্চা গুলোর থেকে যে অকৃত্রিম ভালোবাসা পাওয়া যায় তা অমূল্য। ওদের উৎসাহ আর ভালোবাসায় বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। কাজের চাপে এখন আমাকে ওই ক্লাস গুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে। আমি ওদের প্রত্যেককে মিস করি।

১৬ বিঘা বস্তি মহেশতলার একটি ভালারেবল পকেট। মহেশতলা ১১ নম্বর ওয়ার্ডের স্টেশন সংলগ্ন বস্তি এই ১৬ বিঘা। ২০-২৫ বছর আগে বস্তিটি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গড়ে উঠলেও বর্তমানে ১৬ বিঘার বাসিন্দা প্রায় ৫০০০ হাজার মানুষ। তবে এদের মধ্যে অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক। যারা কাজের প্রয়োজনে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলি থেকে শহরে আসেন। এছাড়াও আছে ময়লা সংগ্রহকারী, নির্মাণকার্য ও রং করার সঙ্গ, বস্তি টি জলা জায়গার ওপরে তৈরি হওয়ায় মশার প্রাদুর্ভাব খুব। এবং প্রতিবছরই ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া হয়। জলা জায়গায় হলেও সমগ্র বস্তিতে পানীয় জলের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। পানীয় জলের জন্য বাসিন্দারা রেললাইন পার হয়ে পাশের বড় রাস্তা পার হয়ে অন্য ওয়ার্ডের টাইম কল থেকে জল সংগ্রহ করতে যান। এছাড়া এনজিও পরিচালিত একটি নলকূপের জলে গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ সারেন। জলের সমস্যা হওয়ার জন্য শিশুদের মধ্যে নানান রকম পেটের সংক্রমণ ও ত্বকের সংক্রমণ হতে দেখা যায় । শিশুদের মধ্যে অনেকেই স্কুল ছুট বা প্রথম থেকে একেবারেই স্কুলে ভর্তি হয়নি। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বয়সন্ধিতেই বেশিরভাগ মেয়ে মা হচ্ছেন। বয়সন্ধির মা হাসপাতালে গেলে সরকারি তরফে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পকসো আইনে মামলা রজু হচ্ছে, সেই কারণেই এখন ১৬ বিঘা বস্তির মায়ের হাসপাতালে যেতে একেবারেই উৎসাহী নন। তারা বাড়িতেই প্রসব করাচ্ছেন। ফলে জন্মের পর প্রথম টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিশুরা।

মহেশতলা পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ইটভাটা এলাকায় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য সমীক্ষা চলছে। মূলত বয়স? তারা কি ধরনের বাড়িতে থাকেন? পানীয় হিসেবে তারা কোন জল পান করেন? পয়প্রণালী কি ধরনের? একই পায়খানা বাথরুম কতজন মিলে ব্যবহার করেন? বাড়ির পুরুষেরা কোন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত? মহিলারা কি বাইরের কোন কাজ করেন? নাকি শুধুমাত্র গৃহস্থালি দেখাশোনা করেন? স্বামীর সংসারে তারা কতটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় রয়েছে। এ'ধরনের তথ্যগুলো, তাদের দৈনন্দিন জীবনধারণের সূচক।

কলকাতার পার্শ্ববর্তী মহেশতলা পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নয়া বস্তিতে বেশ কয়েকটি ইটভাটা আছে। ভাটা গুলিতে প্রতিবছর মরশুমে ভিন রাজ্য থেকে প্রচুর পরিযায়ী শ্রমিক এসে কাজে লাগেন। সঙ্গে আসে তাদের পরিবার-পরিজনেরা। এই জীবনযাত্রায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানান সমস্যায় পড়েন তারা। বিশেষ করে শিশুদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ,শিক্ষা, পুষ্টি এবং রুটিন টিকাকরণ দারুন ভাবে ব্যাহত হয়।

শহরের প্রতিটি বস্তিতেই নিজেদের মতো করে কিছু কাজ গড়ে ওঠে। যা ওই এলাকার বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে তৈরি হয়। এই ছবিটি কলকাতা পুরসভার ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডের তপসিয়া সংলগ্ন বস্তির। নাম মজদুর পাড়া। সেখানকার অনেকেই চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত পরিত্যাক্ত সিরিঞ্জের বিভিন্ন অংশ ভেঙে তা থেকে ভায়েল গুলো ভেঙে কাচের গুঁড়ো তৈরির কাজ। আর ভায়েলের প্লাস্টিকের সিরিঞ্জ ও নজেল অংশটি সংগ্রহ করে একত্রিত করে বিক্রি করেন তারা।

হোম ডেলিভারি বা বাড়িতে প্রসব করানোর ব্যবস্থা, একজন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ এবং স্বাস্থ্যসূচকের নিরিখে এটি একটি খারাপ প্রবণতা। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি মাকে ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারির বিষয়ে উৎসাহ দিলেও এখনো রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় কিছু পকেট থেকে গেছে, যেখানে বাড়িতে প্রসব করানো হয়। এমন কি কলকাতা শহরের কিছু এলাকায়, শহর সংলগ্ন পুরো এলাকা , ও কিছু গ্রামে এখনো হোম ডেলিভারি হয় করানো হয়। নিচের ছবিটি কলকাতা শহরের আশি নম্বর ওয়ার্ডের ইন্দিরা পল্লী বস্তি এলাকার। ছবিটি একটি সদ্যোজাত সন্তানের ,যে সবেমাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে। কোনরকম চিকিৎসক বা চিকিৎসা কর্মী সেখানে ছিল না, ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থাও করতে পারেননি মা। ছবিটি তোলার আগে মায়ের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল।

আমাদের সংগঠন স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের পক্ষ থেকে বাগমারি পূর্ব খালপাড় এলাকায় আম্ফানের পরে মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়েছিল। কলকাতায় আম্ফানের জন্য খুব একটা বেশি ক্ষতি না হলেও এই বস্তি এলাকার জীর্ণ কুটির গুলি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল। কোভিদ চলাকালীন এমনিতেই বহু মানুষ জীবিকা হারিয়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় পড়েছিল। আম্ফানে তারা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইসব সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্যই ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর ফোরাম ও শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের পক্ষ থেকে চিকিৎসকেরা উপস্থিত ছিলেন ওই ক্যাম্পে।

সারা পৃথিবী জুড়ে শিশুরা বিপদের মধ্যে আছে বলে মনে করছে "#unicef"-এর মতো সংস্থা। মূলত যে যে কারণে গোটা পৃথিবী জুড়ে শিশুরা আজ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে সেগুলি হল চরমতম দারিদ্রতা, গৃহহীনতা, গৃহহিংসা, সামাজিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। পরিবারের দিক থেকে যে সমস্যা গুলি শিশুদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে সেগুলি হল গৃহহিংসা, শিশুদের প্রতি বড়দের অবহেলা এবং নিগ্রহের ঘটনা। যেসব শিশুরা একলা মা অথবা একলা বাবার কাছে বড় হয়ে ওঠে তারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়তে বাধ্য হয়। কারণ তাদের ঐ বাবা অথবা মা ভরণপোষণের জন্য বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকায় শিশুটি সামগ্রিকভাবে একটা নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে পড়ে। এছাড়াও, সামাজিক স্তরে লিঙ্গ বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক হিংসা ও অস্থিরতার শিকারও এই শিশুরাই। খাদ্য ,বস্ত্র, বাসস্থানের মত মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। জন্মানোর পরে সারা পৃথিবী জুড়ে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিতে অপুষ্টি, যথাযথ স্বাস্থ্যপরিষেবার অভাব এবং এইচআইভির মতো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে শিশুরা। শিক্ষার জন্য যথার্থ পরিবেশের পাশাপাশি পড়তে না পারা, প্রয়োজনীয় যথাযথভাবে পৃরশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও বিশেষ বাচ্চার জন্য বিশেষ ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবের শিশুদের বিকাশ বিভিন্নভাবে রুদ্ধ হচ্ছে। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবেও অনেক শিশু নানা রকম শারিরিক ও মানসিক বিপদের মধ্যে পড়ছে।

দেশে ১০ থেকে ১৯ বছরের কিশোরীদের ড্রপ- আউটের সংখ্যা বেড়েছে কোভিড পরবর্তী সময়ে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন ১.৪ শতাংশ ,আপার প্রাইমারিতে ৩.৩ শতাংশ এবং সেকেন্ডারি শিক্ষায় ১২.৩ শতাংশ কিশোরী ড্রপ আউট হচ্ছে। মূলত অপুষ্টি, যৌন শিক্ষাহীনতা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা এর পেছনে অনেকভাবপ দায়ী। ১০ থেকে ১৯ বছরের এই সময়টা মানসিক, বৌদ্ধিক এবং শারীরিক বিকাশের সময়। কিন্তু এদেশে দারিদ্রতা, বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়া, প্রেগনেন্সি, স্কুলের থেকে দূরত্ব, শিক্ষকের খারাপ ব্যবহার, পড়াশোনা বুঝতে না পারা, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি নানা কারণে কিশোরীরা স্কুল বা কলেজ থেকে ড্রপ আউট হয়। সেই কারণেই কিশোরী মেয়েদের স্বাস্থ্যের উপর সরকারের আরো বেশি বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। যাতে তাদের মানসিক, বৌদ্ধিক এবং শারীরিক বিকাশ সঠিকভাবে গড়ে ওঠে। এবং তারা সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে নিজেদেরকে মেলে ধরার সুযোগ পায়।

ছবিটি ইন্দিরা পল্লী বস্তি এলাকার ছবি। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম-এর পক্ষ থেকে ইন্দিরা পল্লীতে মাসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক চলে। ওই ক্লিনিকে নিয়মিতভাবে পেটে ব্যথা, পেট ভার, খেতে ইচ্ছে হয় না, সহ পাতলা পায়খানা এইসব সমস্যা নিয়ে শিশুরা চিকিৎসার জন্য আসে। সমস্যার সমাধানে চিকিৎসক ওদেরকে কৃমির ওষুধ দেন। ওই বস্তি এলাকায় শিশুরা যে পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে সেখানে তাদের মধ্যে কৃমি সংক্রমণ একটি সাধারণ সমস্যা। কিন্তু ডাব্লুএইচও-র মতে এটা একটা নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ, যেটা গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ করা উচিত। আসলে শিশুরা কৃমি সংক্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালনারেবল গ্রুপ। খালি হাত পায়ে মাটিতে খেলতে থাকা শিশুর অন্ত্রে কিমি সংক্রমণ ঘটে। বাইরে থেকে এসে হাত পা না ধুয়ে খেতে বসার কারণেই কৃমি নখের মধ্যেকার ময়লার সঙ্গে পেটে চলে যায়। আমাদের মত দরিদ্র দেশে অপুষ্টি ,অশিক্ষা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব, গরম পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারণে কৃমি সংক্রমণ বেশি হয়। অ্যালবেনডাজল ৪০০ দিয়ে কৃমির চিকিৎসা করা হয়।

২০২৪-এ এসেও লিঙ্গ বৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ইউ.এন.এফ.পি.-র ২০০৪-এর রিপোর্ট বলছে গোটা এশিয়া মহাদেশ জুড়ে কন্যা ভ্রুণ হত্যা এবং গর্ভাবস্থায় ভ্রুণ চিহ্নিতকরণের বিষয়টি মেয়েদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই তথ্য অনুযায়ী লিঙ্গ নির্ণয়ের পরে প্রায় ছয় কোটি মহিলার গর্ভপাত করানো হয়েছে। এমনিতেই লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে নানান মৌলিক অধিকার থেকে মেয়েরা বঞ্চিত হয়। বাড়ির খাবার থেকে অন্য সবকিছুতেই তুলনামূলকভাবে তাদের অধিকার খর্ব করার প্রবণতা আজও সমাজে থেকে গিয়েছে। এই সময়ে যৌন নিপীড়ন এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আরোপিত নানা কু-অভ্যাস মেয়ে শিশুদের জীবনকে আরো বিপন্ন করে তুলেছে।

"স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ" তৈরি হয় ২০১৯ নাগাদ। প্রথমে নৈহাটির বন্ধ জুট মিল এলাকার একটি শ্রমিক বস্তিতে আমরা সাপ্তাহিক ক্লিনিক শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই। স্থানীয় একটি ক্লাবের এক ফালি বারান্দায় আমাদের প্রথম ক্লিনিক শুরু হয়। ২০২০ অতিমারীর সময়ে আমরা ওই এলাকার মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি । যে সময় সমস্ত চিকিৎসা কেন্দ্র বন্ধ, মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না, সেরকম সময় কোভিদ বিধি মেনে নিয়মিত ক্লিনিক চালিয়েছি আমরা। এলাকার মানুষদেরকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় সহায়তার জন্য নানা ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে তাদেরকে সচল রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই পর্যায়ে আমাদের টিমের ছবি এটি।

এইচআইভি এইডস, স্তন, ফুসফুস, কোলন ও প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগে যত মানুষ মারা যান তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা যান হঠাৎ করে হার্ট বন্ধ হয়ে। গরিব দেশগুলোতে এই অনুপাত সম্ভবত আরো বেশি। কম ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোতে পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ মানুষ থাকেন, যেখানে হঠাৎ করে হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা বেশি দেখা যায়। এমন ভাবে হার্ট বন্ধ হয়ে গেলে তাকে পুনরায় চালু করার যে পদ্ধতি তাকেই সিপিআর বলা হয়। হঠাৎ করে যাদের হার্ট বন্ধ হয় তাদের মধ্যে ৯০% মারা যাবেন যদি CPR না করা হয়। CPR (Cardiopulmonary Resuscitation)করতে প্রতি মিনিট দেরি করার জন্য বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা ৭% করে কমতে থাকে, আর ১৫ মিনিট হয়ে গেলে বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা থাকেই না বললে চলে। যারা আশেপাশে আছেন তারা যদি সঙ্গে সঙ্গে CPR শুরু করেন তাহলে বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায়। সাধারণ অথচ অতি প্রয়োজনীয় এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে বহু অমূল্য জীবন বাঁচানো সম্ভব। এই লক্ষ্যেই স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের পক্ষ থেকে গত কুড়ি অক্টোবর বসিরহাটের আপন আলয় বৃদ্ধাশ্রমে সিপিআর প্রশিক্ষণের কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক সহ অন্যান্য কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং উপস্থিত দর্শকদেরকে সিপিআর-এর প্রশিক্ষণ দেওয়া। যাতে প্রয়োজনীয় সময় তারা এই প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে মানুষের অমূল্য জীবন রক্ষা করতে পারেন, পাশাপাশি তাদের থেকেও প্রশিক্ষণ নিয়ে এই শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে বহু মানুষের মধ্যে। উপস্থিত আগ্রহীরা অনেকেই হাতে-কলমে সিপিআর প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়েছেন। আশা রাখছি শুধু তারা না, উপস্থিত প্রত্যেকেই তাদের সিপিআর-এর প্রশিক্ষণ-কে আগামী দিনে মানুষের কাজে লাগাতে পারবেন।